

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে বাংলাদেশ কি মধ্যস্থতা করতে পারে?
শাহ জাহান আমির
বিশেষ প্রতিনিধি
০৭/০৫/২৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। এরমধ্যে পানিচুক্তি স্থগিত, বাণিজ্য বন্ধ, ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা, যুদ্ধের মহড়া ইত্যাদির নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবশেষে ভূখণ্ডে হামলা-পাল্টা হামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
বুধবার (৭ মে) পাকিস্তানে সরাসরি হামলা করে ভারত। এতে এখন পর্যন্ত ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার খবর স্বীকার করেছে পাকিস্তান। যদিও ভারত দাবি করছে, এই হামলায় নিহত হয়েছে ৭০ জনেরও বেশি।
ভারতের হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে ১০ ভারতীয় নিহত হয়েছেন বলে খবর দিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। পাশাপাশি পাকিস্তানের বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তিনটি রাফায়েল বিমানসহ মোট পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান।
এরইমধ্যে ভারতীয় হামলার পাল্টা জবাব দিতে সেনাবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি)। ধারণা করা হচ্ছে ভারত যেভাবে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালিয়েছে, এবার পাকিস্তানও একইভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে হামলা করবে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী এর মাধ্যমে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর তেমনটি হলে দক্ষিণ এশিয়াসহ প্রবল ঝাঁকুনি খাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্য; ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বঅর্থনীতি।
জাতিসংঘসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর অবস্থান
ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এমন ধরনের সংঘর্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন। এক বিবৃতিতে তিনি জানান, নিয়ন্ত্রণ রেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে ভারতের সামরিক তৎপরতা গভীর উদ্বেগের বিষয়। আমরা দুই দেশের কাছ থেকেই সর্বোচ্চ সংযত আচরণ প্রত্যাশা করি।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, উপমহাদেশে নতুন করে কোনো সামরিক উত্তেজনা বিশ্ব চাইছে না। পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
এ ছাড়াও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে দুপক্ষকেই শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশ্বনেতারা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এটি লজ্জার। আমরা যখন ওভাল (অফিসের) দরজা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখনই আমরা এটি সম্পর্কে শুনেছিলাম। আমি আশা করি এটি খুব দ্রুত শেষ হবে। তারা (ভারত ও পাকিস্তান) দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। তারা বহু, বহু দশক ধরে লড়াই করছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি (এই পরিস্থিতি) শেষ হবে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ‘দুঃখ’ ও ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে চীন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের বিষয়ে চীন জানিয়েছে, ‘চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান এমন দুই প্রতিবেশী, যাদের আলাদা করা যায় না এবং তারা চীনের প্রতিবেশীও। চীন সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে।
জাপানের প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা হায়াশি এক বিবৃতিতে বলেছেন, গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আমাদের দেশ তীব্র নিন্দা জানায়। একইসঙ্গে আমাদের উদ্বেগ, পরিস্থিতি আরও প্রতিশোধমূলক বিনিময়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আমরা ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সংযম প্রদর্শন এবং সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার জন্য জোরালোভাবে আহ্বান জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের অবস্থান কী?
ভারত-পাকিস্তানের ভেতরে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। বুধবার (৭ মে) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়া এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানানো হয়।
বিবৃতিতে উভয় দেশকে শান্ত থাকার কথা আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ভারত ও পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং উভয় দেশকে শান্ত থাকার, সংযত থাকার এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
এতে বলা হয়, আঞ্চলিক শান্তি, সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার চেতনায়, বাংলাদেশ আশাবাদী যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে শান্তি বিরাজ করবে।
এদিকে বাংলাদেশের এই অবস্থানকে সঠিক বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল আলম। আরটিভির সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, যুদ্ধ বা সংঘাত কোনো পক্ষের জন্যই সুখকর কিছু হবে না। এ দুই দেশ সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে কেউ জিতবে না। বরং দুটিই পক্ষই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বমোড়লদের কেউ কেউ হয়তো চাইছেন উভয় দেশে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। তাতে তাদের প্রভাব, অস্ত্রবিক্রি বা ব্যবসার সুযোগ বাড়বে। কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দুটি দেশের জন্যই যে বোকামি হবে, ধ্বংস ডেকে আনবে, সেটি দুই দেশের নীতি নির্ধারকদেরকেই বুঝতে হবে।
বাংলাদেশ কি মধ্যস্থতা করতে পারে?
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও বিশ্বব্যাপী ক্লিন ইমেজ তার সরকারের প্রতি বিশ্বমোড়লদের প্রশ্নহীন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন এনে দিয়েছে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সঙ্গেই ড. ইউনূসের সরকার যোগাযোগ বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া দুই দেশের ভেতরে উত্তেজনা প্রশমনেও বাংলাদেশ কী ভূমিকা রাখতে পারে, সেটি নিয়েও চলছে আলোচনা।
সম্প্রতি এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। আমরা জানি যে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি চাই। দীর্ঘদিন ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘাতময় সম্পর্কের মধ্যে আছে। আমরা চাই না যে এখানে বড় কোনো সংঘাত সৃষ্টি হোক, যা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।’
‘এই মুহূর্তে আমাদের মধ্যস্থতার কোনো ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। আমরা আগ বাড়িয়ে কিছু করতে চাই না’, বলেছিলেন তিনি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতার সুযোগ কম বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ শামস মুরসালিন। আরটিভিকে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার হয়েছে এটা ঠিক। এমন চেষ্টা হলে পাকিস্তান হয়তো গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে পারে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে এই বিবাদে আমাদের মধ্যস্থতা করার সুযোগ কম।
তিনি আরও বলেন, এর বাইরে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি, কূটনৈতিক প্রভাবও খুব বেশি নয়। ফলে দু’পক্ষকে একই টেবিলে বসানোর কাজটি সত্যিই বাংলাদেশের জন্য ভীষণ কঠিন।
তবে এ প্রসঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন অধ্যাপক ড. শামছুল আলম। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের ঐতিহাসিক বৈরিতা রয়েছে। এখানে মধ্যস্থতা ভীষণ কঠিন। কিন্তু ড. ইউনূসের যে পরিচিতি আছে, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে, তিনি প্রস্তাব দিতেই পারেন। সেটি দু’পক্ষ কতটা গ্রহণ করবে সেটা পরের বিষয়। কিন্তু এতে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্বল হবে।
‘কোনো দেশের মানুষই যুদ্ধ চায় না। আমরাও চাই না। তাই দেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের মধ্যস্থতার প্রস্তাবে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও একমত হবে। জিয়াউর রহমানও আন্তর্জাতিক বিবাদে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। ড. ইউনূসের পক্ষ থেকেও আমরা তেমনটাই আশা করি,’ যোগ করেন ড. শামছুল আলম।