

কারাগারের ছাদ ফুটো করে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত পালানো আসামি ৪ রহস্য এবং প্রধান কারারক্ষীসহ বরখাস্ত ৩
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ স্বপন
বগুড়া জেলা কারাগার থেকে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী চার জন ছাদ ফুটো করে পালিয়ে যায় এবং এঘটনা কেন্দ্র করে প্রধান কারারক্ষীসহ তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
ছাদ ফুটো করতে ওই কয়েদিরা একটি লোহার পাত ও স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহার করেছিলেন। কারাগার থেকে পালানোর পর আসামিদের গ্রেপ্তার করলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এমনটিই জানিয়েছেন তারা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জাফলং নামের ভবনটির ছাদ অনেক পুরাতন চুন সুরকি ও মাটির টালি দিয়ে তৈরি করা। এ থেকেই তারা ছাদ ফুটো করে পালানোর পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে তাদেরকে সেলে রাখার কয়েক দিন পর থেকেই প্রতি রাতে একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠে দেয়াল ঘষে ফুটো করতে শুরু করেন। দিনের বেলা তারা ওই স্থানটি গামছা দিয়ে ঢেকে রাখতেন যেন কেউ দেখতে না পায়।
২০ দিনের বেশি সময় চেষ্টার পর সেল থেকে বের হওয়ার মতো উপযুক্ত ফুটো করে তারা মঙ্গলবার (২৫ জুন) রাত দুইটার পর থেকে কাপড়-চোপড়সহ নিজেরা বের হওয়া শুরু করে। এরপর তাদের পরিধেয় কাপড় চোপড় এবং বিছানার চাদর জোড়া দিয়ে রশি বানিয়ে দেওয়াল টপকিয়ে পালান। জেলখানা থেকে পালিয়ে জেলসংলগ্ন করোতোয়া নদী দিয়ে চেলোপাড়ায় পৌঁছান।
পলাতক চারজনের মধ্যে ফরিদ শেখের আত্মীয় বাড়ি চেলোপাড়ার পার্শ্ববর্তী এলাকা নারুলীতে। তারা সেখানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য চেলোপাড়া ব্রিজের কাছে নদী থেকে উঠার চেষ্টা করছিলেন। এরমধ্যে কয়েদিদের কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জেলা পুলিশকে জানালে পুলিশ তাদের ধরতে টহল শুরু করে। পলাতক কয়েদিরা নদী ভেঙে চেলোপাড়া চাষী বাজার এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের নামে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেছে বগুড়া জেলা কারাগারের জেলার ফরিদুর রহমান রুবেল।
পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, বগুড়ার কারাগারটি ৭০০ বন্দী ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। তবে কারাগারটিতে বন্দী আছেন ২ হাজার ২০০ জন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ওই চার আসামি একটি সেলে গাদাগাদি করে ছিলেন। ওই সেলের ভেতরে কারারক্ষী যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সেলটিতে পাঁচ জন ঢুকলে একজনের গায়ের সাথে আরেকজনের গা লেগে থাকবে। কারাকক্ষের যে জায়গায় ছাদে ফুটোটি করা হয়েছে, সেটি ভেতরে না ঢুকলে বোঝার উপায় নেই।
বগুড়া কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ‘জাফলং’ সেলের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কারারক্ষীরা থাকেন। আর কারাগারের দেয়ালের বাইরের অংশের নিরাপত্তায় ২৪ ঘণ্টা ১২ জন কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে আটজন টহলে থাকেন এবং চারজন কারাগারের বিভিন্ন অংশে নিরাপত্তা বক্সে থেকে দায়িত্ব পালন করেন।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘‘আমরা কারাগার পরিদর্শন করেছি। ঘটনার পর কারাগার কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করছে। সিসি ক্যামেরা অনেকগুলো সচল ছিলো। এসব সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তদন্তের কাজে নিশ্চয়ই ব্যবহার হবে। তবে সবগুলো সিসি ক্যামেরা সচল ছিলো কি না আমরা সেটা এখনো পর্যবেক্ষণ করিনি। আমরা মূলত জাফলং সেলে যেখানে ওই কয়েদিরা ছিলেন এবং যে প্রান্ত দিয়ে তারা পলায়ন করেছে সেই জায়গাগুলো দেখেছি। সেখানে বেশ কিছু ফুটেজ পাওয়া গেছে।
‘আসামিদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি, যেহেতু জাফলং সেল অনেক পুরনো, এটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এবং ছাদ ইট সুরকির ছিলো। তাই তারা মরিয়া হয়ে এই সুযোগটি নিতে চেয়েছে। গভীর রাতে তারা এটি ফুটো করে পলায়ন করবে। যেন করে কেউ তাদেরকে দেখতে না পায়। তারা কিন্তু সেই কাজটিই করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা যে তথ্যগুলো পেয়েছি- তাদের কাছে এক ধরনের লোহার একটি পাত, স্ক্রু ড্রাইভার এবং তারা শৌচাগারে যে বালতি ব্যবহার করতো তার হাতল ব্যবহার করে তারা ছাদ ফুটো করেছে। এটা তারা নিজেরাই বলেছে। আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তা এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন আছে। তাদেরকে বিষদভাবে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এবং স্বাক্ষ্য প্রমাণাদির মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হতে পারবো তারা কীভাবে কী করেছে।”
মামলা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি মামলা, সেহেতু সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর সুজন মিয়াকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত করেছি। এখন আমরা যে কাজটি করব, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে কয়েদিরা পলায়ন করেছিলো তাদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিজ্ঞ আদালতে রিমান্ড চাইব। রিমান্ডে আনার পর তাদেরকে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তাদের এই পরিকল্পনার মূল বিষয়গুলো প্রত্যক্ষভাবে জানা যাবে। পাশাপাশি তাদের কোনো সহযোগী ছিল কি না, কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছিলো কি না সেই বিষয়গুলোও তদন্তে উঠে আসবে। আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছি। ইতোমধ্যে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা আছেন, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছেন।’
বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বগুড়া কারাগারটি অনেক পুরাতন। এটি ব্রিটিশ আমলে তৈরি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ভবনের অনেক স্থান নাজুক। ওরা ছাদের যে অংশে ফুটো করেছে সেখানে কোনো রড ছিল না। যে সেলগুলো আছে সেগুলোও অনেক আগের। চুন-সুরকির সেল। এটা যে কিছু দিয়ে সহজেই ফুটো করে ফেলা সম্ভব। বিষয়গুলো আমরা গণপূর্তকে বলেছি পুনরায় যাচাই বাছাই করার জন্য। আমাদের কমিটির মধ্যেও রাখা হয়েছে আসলে এটা কতটা নিরাপদ।’
এদিকে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি পালানোর ঘটনায় বগুড়া কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত কয়েদি, জঙ্গি মামলায় অভিযুক্তসহ আসামিদের অন্য কারাগারে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তিন জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং দুজন যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিকে রাজশাহী বিভাগীয় কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন বলেন, ‘বিষয়টি এখনও আমাদের কাছে নোটিসে আসেনি। এলে আপনাদের জানাতে পারব।’
তবে এ বিষয়ে জানতে জেলসুপার আনোয়ার হোসেনকে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জেল গেটে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেও তাঁর দেখা মেলেনি। পরে একসময় কারা পুলিশ তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার (২৫ জুন) দিবাগত রাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার কয়েদি কারাগার থেকে পালিয়ে যান। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় পুলিশ চেলোপাড়ার চাষী বাজার এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার (২৬ জুন) রাতে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে প্রধান কারারক্ষী দুলাল হোসেনসহ তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় আরও দুই কারারক্ষীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে বগুড়া জেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলাকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। তবে বগুড়া কারাগারের জেল সুপার আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
কনডেম সেলের ছাদ কীভাবে ছিদ্র করে ফাঁসির আসামিরা পালিয়ে গেলেন এবং তাদের গায়ে জেলের পোশাক না থাকা নিয়েও নানান প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
এই ঘটনায় জেল পালানোর জন্য ওই চার আসামীর বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী।
এছাড়া বুধবার (২৬ জুন) দুপুরে এ ঘটনায় বগুড়া জেলা প্রশাসকের গঠিত ছয় সদস্যের এবং অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক শেখ সুজাউর রহমান সুজার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) থেকে জেলা প্রশাসন ও ডিআইজি প্রিজনের গঠিত পৃথক কমিটি ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।